এ কে ফজলুল হক
বাঙালি রাজনীতিবিদ । বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাঙালি কুটনীতিক হিসেবে বেশ পরিচিত ছিলেন। রাজনৈতিক মহল এবং সাধারণ মানুষের কাছে 'শেরেবাংলা' নামে পরিচিত। তিনি যে-সব রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন তার মধ্যে কলকাতার মেয়র(১৯৩৫), অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী (১৯৩৭-১৯৪৩), পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী (১৯৫৪), পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (১৯৫৫), পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর (১৯৫৬-১৯৫৮) অন্যতম। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এ. কে. ফজলুক হক বহু কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। শিক্ষা ক্ষেত্রেই জোর দিয়েছিলেন বেশি। তার আমলে দরিদ্র কৃষকের উপরে কর ধার্য না করে সারা বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করা হয়। বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেন। এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য বৃটিশ সরকার ১৯৩৮ সালে ক্লাউড কমিশন গঠন করে। ১৯৩৮ সালের ১৮ আগস্ট বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধনী পাস হয় এবং জমিদারদের লাগামহীন অত্যাচার চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়। ১৯৩৯ সালের ‘বঙ্গীয় চাকুরি নিয়োগবিধি’ প্রবর্তন করে মন্ত্রিপরিষদ মুসলমানদের জন্য শতকরা ৫০ ভাগ চাকুরি নির্দিষ্ট রাখার ব্যবস্থা করে। এ বছরেই ‘চাষী খাতক আইন’-এর সংশোধনী এনে ঋণ সালিশী বোর্ডকে শক্তিশালী করা হয়। ক্লাউড কমিশনের সুপারিশ অনুসারে ১৯৪০ সালে হক সাহেব আইন পরিষদে ‘মহাজনী আইন’ পাস করান। এ বছরই ‘দোকান কর্মচারি আইন’ প্রণয়ন করে তিনি দোকান শ্রমিকদের সপ্তাহে একদিন বন্ধ ও অন্যান্য সুবিধা প্রদানের নির্দেশ জারী করেন। কৃষি আধুনিকায়নের জন্য ঢাকা, রাজশাহী এবং খুলনার দৌলতপুরে কৃষি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাট চাষীদের নায্য মূল্য পাওয়ার লক্ষ্যে ১৯৩৮ সালে ‘পাট অধ্যাদেশ’ জারি করা হয়। ১৯৪১ সালের ১২ ডিসেম্বর আবুল কাশেম ফজলুল হক দ্বিতীয় বারের মত মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। শরৎচন্দ্র বসু ও হিন্দু মহাসভার সহ-সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সঙ্গে প্রগতিশীল যুক্ত পার্টি গঠন করে তিনি সেই দলের নেতা হয়েছিলেন। ১৭ ডিসেম্বর এই মন্ত্রী পরিষদ বাংলার গভর্ণর জেনারেল হার্বাটের কাছে শপথ গ্রহণ করেন। যুক্তফ্রন্ট গঠনে প্রধান নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
আবদুর রব সেরনিয়াবত
আবদুর রব সেরনিয়াবত ১৯২১ সালে জন্মগ্রহণ করেন বরিশালের গৌরনদী উপজেলার সরাইল গ্রামে। বরিশালের বিএম কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার আরম্ভ হয় গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে (১৯৫৬-১৯৫৭)। পরবর্তী সময়ে তিনি ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আবদুর রব সেরনিয়াবত ১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন ও মুজিবনগর সরকার গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭২ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি পুনর্বার বরিশাল থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে তিনি নিহত হন।
বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর ১৯৪৯ সালে বরিশালের বাবুগঞ্জ থানার রহিমগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৬৬ সালে আইএসসি পাশ করার পর বিমান বাহিনীতে যোগদানের চেষ্টা করেন, কিন্তু চোখের অসুবিধা থাকায় ব্যর্থ হন। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায়ই পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক পদক বীরশ্রেষ্ঠ পদক দেয়া হয় মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরকে। বরিশালের নিজ গ্রামের নাম তাঁর দাদার নামে হওয়ায় পরিবার ও গ্রামবাসীর ইচ্ছে অনুসারে তাঁর ইউনিয়নের নাম 'আগরপুর' পরিবর্তন করে 'মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর' ইউনিয়ন করা হয়েছে৷ সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে বরিশাল জেলা পরিষদ ৪৯ লক্ষ টাকা ব্যয়ে বীরশ্রেষ্ঠের পরিবারের দান করা ৪০ শতাংশ জায়গার ওপর নির্মাণ করেছে বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার৷
জীবনানন্দ দাশ
জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) বিশ শতকের অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি।তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃৎদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে যখন তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কবিতে পরিণত হয়েছেন। তিনি প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন। তবে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে অকাল মৃত্যুর আগে তিনি নিভৃতে ১৪টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প রচনা গ্রন্থ করেছেন যার একটিও তিনি জীবদ্দশায় প্রকাশ করেননি। তাঁর জীবন কেটেছে চরম দারিদ্রের মধ্যে। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধকাল অনপনেয়ভাবে বাংলা কবিতায় তাঁর প্রভাব মুদ্রিত হয়েছে। রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসাবে তিনি সর্বসাধারণ্যে স্বীকৃত। তাঁর লেখা বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলো হলো : ঝরা পালক (১৯২৭), ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬), বনলতা সেন (১৯৪২), মহাপৃথিবী (১৯৪৪), সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮), বনলতা সেন (১৯৫২)।
কুসুমকুমারী দাশ
কুসুমকুমারী দাশ একজন বাঙালি মহিলা কবি। কবিতাপ্রেমী বাঙালির কাছে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রের নামটি নিবিড়, নির্জন ও নস্টালজিক এক কবিতার মতো। তিনি কবি জীবনানন্দ দাশ। কবি বলেন, ‘...মার মুখের ভাষা কি রকম প্রাণক্ষরা ছিল, কত লোকগাথা ও প্রবাসের যথোচিত সংমিশ্রণে তীর্যক ও উজ্জ্বল হয়ে উঠত, ....তা শুনেছি, বুঝেছি।’ তাঁর রচিত আদর্শ ছেলে, যার প্রথম চরণ ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে’, বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কবি কুসুমকুমারী দাশ বরিশাল শহরে ২১ পৌষ ১২৮৯ বঙ্গাব্দে এক বিদ্যানুরাগী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা চন্দ্রনাথ দাস এবং মাতা ধনমণি। চন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করায় গ্রামবাসীদের বিরোধিতায় গৈলা গ্রামের পৈতৃক ভিটা ছেড়ে বরিশালে চলে আসেন। কুসুমকুমারী একটি পারিবারিক পরিমণ্ডল পেয়েছিলেন। বরিশাল ব্রাহ্মসমাজ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের হাই স্কুলে তিনি ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন। এরপর বালিকাদের অভাবের জন্য স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেলে কুসুমকুমারীকে তাঁর বাবা কলকাতায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের গৃহে রেখে বেথুন স্কুলে ভর্তি করেন। একবছর পর ব্রাহ্মবালিকা বোর্ডিং-এ লাবণ্যপ্রভা বসুর তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা করেন। ছোটবেলা থেকেই কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতেন কুসুমকুমারী। তিনি সম্পাদক মনোমোহন চক্রবর্তীর অনুরোধে লিখেছেন ব্রহ্মবাদী পত্রিকায়। তাঁর অল্প কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়েছে প্রবাসী ও মুকুল পত্রিকায়। তাঁর কবিতায় বার বার এসেছে ধর্ম, নীতিবোধ, দেশাত্মবোধ। কাব্য মুকুল (১৮৯৬) তাঁর কাব্যগ্রন্থ। পৌরানিক আখ্যায়িকা নামের একটি গদ্যগ্রন্থও তিনি রচনা করেন।
মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত
জনহিতৈষী ও জাতীয়তাবাদী নেতা মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত বৃহত্তর বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার অন্তর্গত বাটাজোরের একটি ছোট গ্রামে সচ্ছল কায়স্থ ভূম্যধিকারী পরিবারে ১৮৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ব্রজমোহন দত্ত একজন সাব-জজ ছিলেন। ব্যাচেলর অব আর্টস এবং মাস্টার্স অব আর্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের এ দুটি ডিগ্রিধারী অশ্বিনীকুমার দত্ত তাঁর জীবনের পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নেন। অবশ্য বরিশাল জেলা আদালতে স্বল্পকাল তিনি আইন ব্যবসায়ে নিয়োজিত ছিলেন। মানবপ্রেম এবং জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে তাঁর ভূমিকার জন্য তিনি সুপরিচিতি লাভ করেন। সমাজের কল্যাণ এবং উন্নয়নের প্রতি গভীরভাবে নিবেদিত হয়ে তিনি বরিশাল শহরের মধ্যে নিজের দান করা এলাকায় ব্রজমোহন বিদ্যালয় (১৮৮৪) ও ব্রজমোহন কলেজ (১৮৮৯) প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর ছাত্রদের শারীরিক এবং নৈতিক দিকসমূহ বিকাশের জন্য তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে দীর্ঘ কুড়ি বছর বিনা বেতনে কলেজে শিক্ষাদান করেন। তিনি বরিশাল শহরে একটি বালিকা বিদ্যালয়ও (১৮৮৭) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর সারাজীবনের সহিষ্ণু সমাজসেবা তাঁকে স্থানীয় জনগণের কাছে খুবই প্রিয় করে তোলে। জনগণের সদিচ্ছা ও তাঁর পরিবারের সম্পদ ও প্রভাবের কারণে তিনি এমন জনসমর্থন লাভ করেন যা তাঁকে ১৯০৫-১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় সংকীর্ণ জেলা পর্যায় থেকে বৃহত্তর প্রাদেশিক রাজনৈতিক অঙ্গনে নিয়ে যায়। এ প্রক্রিয়ায় তিনটি স্থানীয় সংগঠন জনসমিতি (১৮৮৬), বাখরগঞ্জ হিতৈষিণী সভা (১৮৮৭) এবং নেত্রী সংঘ তাঁর সহায়ক হয়েছিল। এ সংগঠনগুলির তিনিই ছিলেন পথপ্রদর্শক এবং এগুলির কর্মকান্ডে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি বরিশাল পৌরসভার কমিশনার (১৮৮৫) হয়ে এর ভাইস চেয়ারম্যান (১৮৮৮) ও চেয়ারম্যান (১৮৯৭)-এর দায়িত্ব পালন করেন।
সুফিয়া কামাল